মারজিয়া আল-হাকীম
আমাদের পূর্ববর্তী “যুম ফ্যাটিগ” লেখাটি তে আমরা জেনেছি বিষয়টি কি। ইতোমধ্যেই নিশ্চয়ই আমরা নিজেদের সাথে মিলিয়েও দেখতে পেরেছি। এই লক ডাউন এ আমরা যারা ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছি তাঁরা কম বেশি সবাই ই এর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি বা গিয়েছি। “যুম ফ্যাটিগ” (অনলাইন এ ভিডিও কল অথবা ভিডিও কনফারেন্সিং এ দীর্ঘসময় ধরে কথা বলা অথবা মিটিং করার ফলে, আমাদের মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে পরা) -এর প্রভাবে কিছু শারীরিক ও মানসিক ঝুঁকি তৈরি হতে পারে যেমন – মাথা বা ঘাড়ে ব্যাথা, চোখে চাপ তৈরি হওয়া এবং বিভিন্ন রকম অসুবিধা দেখা দেওয়া, ঘুমের অনিয়ম তৈরি বা সমস্যা, এবং ফলস্বরূপ এক পর্যায়ে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনার উপর প্রভাব পরারও সম্ভাবনা থাকে। মনোবিজ্ঞানী ও গবেষকরা বলছেন, ভিডিও কল এ থাকার সময়ে অনলাইনে একই সাথে বিভিন্ন কাজ করা বা বিভিন্ন সাইট এ মনোযোগ বিভাজিত করে দেওয়ার কারণে মস্তিস্কের উপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়। অস্থিরতা, উদ্বেগ (anxiety), মানসিক ভাবে মোবাইল বা কম্পিউটার এর উপর নির্ভরশীলতা (dependency), এক পর্যায়ে ক্লান্তি ও মনোযোগ দেওয়ার সমস্যাও তৈরি হতে পারে। এমনকি কারো কারো মাঝে উচ্চরক্তচাপ (hypertension) ও দেখা দিয়েছে।
উপরোক্ত লক্ষণ বা সমস্যা গুলো হয়তো সবার হয় না বা হচ্ছে না, কিন্তু বিষয়টি সমস্যা পর্যায়ে চলে যাওয়ার আগেই আমরা নিয়ন্ত্রণ করে নিয়ে আসতে পারি। আসুন কিছু উপায় আলোচনা করা যাক -
সারাদিনের কাজের একটি রুটিন তৈরি করুনঃ
দিনে কতক্ষন ভিডিও কল বা মিটিং এ সময় পার করবেন তার একটি পরিকল্পনা করুন। গুরুত্বপূর্ণ মিটিং বা ভিডিও কল গুলো কে অগ্রাধিকার দিন। অফিসের মিটিং বা কাজ গুলোর মাঝেও একটি অগ্রাধিকার তালিকা তৈরি করুন, কোন মিটিং বা অনলাইন এ কাজ গুলো আজকের মধ্যেই করতে হবে আর কোন গুলো পরের দিন করলেও চলবে। আবার অফিসের বা পড়ালেখার কাজের বাইরেও এই লকডাউন এ আমাদের ভিডিও কল এর মাধ্যমে পারিবারিক ও সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা করতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রেও একটি অগ্রাধিকার তালিকা তৈরি করুন; নিজের স্বাস্থ্য, আরও একটি কল এ যোগদান করার মানসিক সক্ষমতা এবং দিনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ যেমন সময়মত খাওয়া, ঘুম এবং পরিমিত শারীরিক শ্রম ইত্যাদির জন্যে যথেষ্ট সময় আছে কিনা এগুলো ভেবে সিদ্ধান্ত নিন আজকে বা একদিনে কয়টি একান্ত গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এ যোগদান করবেন এবং কয়টি কম প্রয়োজনীয় মিটিং এ যোগদান করবেন।
নিয়ম করে বিরতি নিনঃ
দৈনিক রুটিন বানানর সময়ে বিশেষভাবে লক্ষ্য রেখে কাজের মাঝে নিয়মিত বিরতি নেওয়ার সময় ও রাখুন। বিরতির সময়টি কীভাবে কাটাবেন সেটিরও একটি পরিকল্পনা রাখতে পারেন। অবশ্যই চোখ ও মস্তিষ্ক কে রিলাক্স করার মত পরিকল্পনা রাখাই উত্তম।
২০-২০-২০ নিয়মটি (Digital Viewing Law) অনুসরণ করুনঃ
“আমেরিকান অপ্টমেট্রি অ্যাসোসিয়েশন” অনুমোদিত নিয়ম হচ্ছে – প্রতি ২০ মিনিট একটানা মোবাইল বা কম্পিউটার এর পর্দায় তাকিয়ে কাজ করার মাঝে একটি বিরতি নেওয়া এবং এই বিরতিতে ২০ ফুট দূরত্বের অন্য কোন জিনিস এর দিকে ২০ সেকেন্ড ধরে তাকিয়ে থাকা। এই প্রক্রিয়াটির কার্যকারিতা নিয়ে এই পর্যন্ত অপেক্ষাকৃত কম গবেষণা হয়ে থাকলেও, এই প্রক্রিয়াটি আমেরিকান অপ্টমেট্রি অ্যাসোসিয়েশন এবং আমেরিকান একাডেমি অফ অপথ্যামোলজি দ্বারা অনুমোদিত এবং প্রমাণিত। এবং এই প্রক্রিয়ায় বিরতি নেওয়ার ফলে চোখের পেশী গুলো রিলাক্স হয়ে থাকে এবং চোখের উপর চাপ কমে।
মাইন্ডফুলনেস চর্চা করুনঃ
“মাইন্ডফুলনেস” এমন একটি দক্ষতা যা চর্চার মাধ্যমে আমরা সম্পূর্ণভাবে বর্তমান মুহূর্তে মনোযোগ দিতে পারি – এখন কোথায় আছি, কি করছি, আমার অনুভুতি কি হচ্ছে এবং ঠিক এই মুহূর্তে কি ভাবনা কাজ করছে মাথায় ইত্যাদি বিষয়ে সম্পূর্ণভাবে ফোকাস করতে পারা। এই ক্ষমতা টি সচরাচর আমাদের মাঝে থাকলেও আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা, বর্তমান মানসিক পরিস্থিতি বা ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা ইত্যাদি আমাদের কে সম্পূর্ণরুপে বর্তমানে থেকে কাজ করতে ব্যাহত করে। তাই এই দক্ষতা কে বিভিন্ন অনুশীলন এর মাধ্যমে শিখা এবং চর্চা করা প্রয়োজন – যা একটি বিশদ আলোচনা। এখানে সংক্ষেপে এটাই আলোচ্য যে – যুম ফ্যাটিগ কাটানোর জন্যে আমরা মাইন্ডফুলনেস চর্চা শিখতে এবং চর্চা করতে পারি।
সিঙ্গেল-টাস্কিংঃ ওয়ান থিংগ অ্যাট এ টাইমঃ
আমাদের মাঝে এক ধরণের ভুল ধারণা আছে যে “মাল্টিটাস্কিং” বা এক সাথে একের অধিক কাজ করতে পারতেই হবে। অনেকে মাল্টিটাস্কিং করতে পারেন, তাদের কোন অসুবিধা হয় না। কিন্তু জোড় করে মাক্টিটাস্কিং করতে যেয়ে নিজের উপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করে ফেলছি কিনা এ বিষয়ে সচেতন থাকা প্রয়োজন। কারণ “মাল্টিটাস্কিং” এর ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে আমাদের মস্তিষ্কের কাজ করার সামর্থ্য বা মনোযোগের পরিমান বিভাজিত করে বিভিন্ন কাজে দিতে হয় যার ফলে কাজটি তেও কম মনোযোগ পরে এবং মস্তিস্কেও অতিরিক্ত চাপ পরে। যুম ফ্যাটিগ মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে “সিঙ্গেল টাস্কিং” – কোন নির্দিষ্ট সময়ে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে একটি কাজই করা” – খুবই জরুরী। গবেষণায় দেখা গিয়েছে এবং নিউরোসাইন্টিস্টরা বলছেন “সিঙ্গেল টাস্কিং” আমাদের কার্যকারিতা বাড়ায় এবং এর ফলে কাজে সাফল্য আসাও সম্ভব। “মাইন্ডফুলনেস” চর্চার মাধ্যমে আমরা এভাবে “ওয়ান থিংগ এট এ টাইম” করে আমাদের কাজ গুলো একের পর এক রুটিন মত শেষ করতে পারি এবং নিজের মস্তিষ্ককে অতিরিক্ত চাপ থেকে রক্ষা করতে পারি।
মিটিং বা ভিডিও কনফারেন্স চলাকালীন খেয়াল রাখুনঃ
মিটিং চলাকালীন কাজ এ মনোযোগ দেওয়ার পাশাপাশি খেয়াল রাখা প্রয়োজন আমরা কেমন অনুভব করছি। যদি মনে হয় দীর্ঘক্ষণ মিটিং চলায় আমরা চাপ অথবা ফ্যাটিগ অনুভব করছি, তাহলে ছোট্ট বিরতি নেওয়ার পরিকল্পনা রাখা যায়। এছাড়াও যে মাধ্যমেই মিটিং বা ভিডিও কল চলুক না কেন (যুম, গুগল মিট, স্কাইপ ইত্যাদি), যে অপশন গুলো ব্যাবহার করে আপনার মাথায় ও চোখে কম চাপ পরে সেই অপশন গুলো ব্যাবহার করুন। যেমন যুম এপ্লিকেশন এ “স্পীকার ভিউ” অনেকটা সাহায্য করে কম ক্লান্তি তৈরি করতে। আপনার ক্ষেত্রে কোন অপশন গুলোতে সুবিধা হয় সেগুলা খুজে বের করুন এবং ব্যাবহার করুন।
অনলাইনের বাইরেও সম্ভব হলে সরাসরি মানুষের সাথে সময় কাটানঃ
অনেকের ক্ষেত্রে এটি সম্ভব আবার অনেকের ক্ষেত্রে হয়তো আপাতত সুযোগ নেই। যদি সুযোগ থাকে বা ব্যাবস্থা করা সম্ভব হয় তাহলে দৈনন্দিন রুটিন এ বিরতির মাঝে ও কাজ শেষে একটি সময় সরাসরি মানুষের সাথে কথা বলা বা সময় কাটানো খুবই উপকারি এবং জরুরী।
মনে রাখতে হবে, আপনি যদি চিহ্নিত করতে পারেন যে আপনার যুম ফ্যাটিগ হচ্ছে, তাহলে আপনি উপরোক্ত আলোচনার বাইরেও এমন কিছু চর্চা করতে পারেন যা আপনাকে এই ফ্যাটিগ মোকাবিলা করতে সহযোগিতা করতে পারে। শুধু প্রয়োজন সচেতন থাকা এবং নিজের দিকে খেয়াল রাখা। লক ডাউন এর ফলে এই অনলাইন ভিত্তিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং প্রক্রিয়াগুলো শুধু যে আমাদের ক্ষতি করছে তা নয়, বয়ে নিয়ে আসছে আমাদের অনেক সুবিধাও। এই মাধ্যম গুলোর সঠিক এবং স্বাস্থ্যসম্যত ব্যবহার এর মাধ্যমে আমরা একটি সুন্দর জীবনযাপন করতে পারি।